জান্নাতি লোকদের মধ্যে অধিক নিয়ামতের অধিকারী তারাই হবে, যারা নিজেদেরকে দুনিয়াতে হারাম কাজ থেকে বাঁচাবে। পৃথিবীতে যে লোক শরাব পান করবে সে জান্নাতের পবিত্র শরাব থেকে বঞ্চিত থাকবে। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি রেশমের পোশাক পরিধান করবে সে জান্নাতে রেশমী পোষাক পড়া থেকে বঞ্চিত থাকবে। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি স্বর্ণ রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করেছে জান্নাতে সে এগুলোতে পানাহার করতে পারবেনা। এ ব্যাপারে নবী করীম সা. এরশাদ ফরমান- انها لهم في الدنيا ولكم في الاخرة

এ দুনিয়াতো কাফেরদের জন্য আর পরকাল রয়েছে তোমাদের জন্য। [বুখারী] তবে কোন মুসলমান এ জগতে এ সমস্ত হারাম বস্তুর শিকার হয়ে, পরবর্তীতে তাওবাহ করলে জান্নাতে তাদেরকে এ সমস্ত নিয়ামত দেয়া হবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি আরাম আয়েশের সকল প্রকার উপকরণাদি ব্যবহার করেছে সে জান্নাতে কোন না কোন দিক দিয়ে এগুলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এ জন্য সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের অনুসারীরা এ থেকে ভীত অবস্থায় ছিলেন। ইমাম আহমাদ রহ. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা.থেকে বর্ণনা করেন যে,  হযরত জাবের রা. গোশত ক্রয় করে বাড়িতে যাচ্ছিলেন। হযরত ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন এগুলো কি? হযরত জাবের রা. বললেন, এগুলো গোশত। এগুলো আমার পরিবারের লোকদের জন্য এক দেরহামে ক্রয় করেছি। তখন হযরত ওমর রা. বললেন, আপনাদের মনে যা চায় তাই ক্রয় করুন। আপনারা কি  আল্লাহ তাআলার বাণী শুনেননি? আল্লাহ বলেন-‘যেদিন কাফেরদেরকে জাহান্নামের কাছে উপস্থিত করা হবে। সেদিন বলা হবে তোমরা তোমাদের সুখ পার্থিব জীবনেই শেষ করে ফেলেছ এবং এগুলো ভোগ করেছো। [আহকাফ:২০]
হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, একদা বসরা থেকে হযরত আবু মুসা আশআরী রা. এর নেতৃত্ত্বে একটি প্রতিনিধি দল হযরত ওমর রা. এর খেদমতে হাজির হল। প্রতিনিধি দল বলেন আমরা প্রতিদিন হযরত ওমর রা. এর  খেদমতে  যেতাম এবং পানিতে ভেজানো রুটি দেখতাম। কখনো আমরা তা ঘি লাগানো দেখতাম। আবার কখনো তৈল লাগানো দেখতাম। কখনো শুকনো গোশতের টুকরা গুড়া করে পানিতে গরম করা হত। আমরা খুব কম সময়ই তাজা গোশত দেখতে পেতাম। একদিন হযরত ওমর রা. বলেন, আল্লাহর শপথ আমি তোমাদিগকে দেখতে পাচ্ছি যে, তোমরা আমার খানা পছন্দ করছো না। আল্লাহর শপথ আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের চেয়ে অধিক রং বেরঙের খানা খেতে পারি এবং অধিক মূল্যবান খাবার তৈরি করতে পারি। কিন্তু আমি আল্লাহ পাকের বাণী শুনেছি যে, তিনি সে গোত্রের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরেছেন যারা এ ধরনের কাজ করেছেন এবং এরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের সুখ পার্থিব জীবনেই নিঃশেষ করে ফেলেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছো।
দু’টি বিশিষ্ট জান্নাতের আভিজাত্য
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, كان عرشه علي الماء  আল্লাহর আরশ ছিল পানির উপর। উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য একটি জান্নাত তৈরি করলেন। তারপর উহাকে একটি মুক্তা দ্বারা জড়িয়ে দিলেন। তারপর ইবনে আব্বাস রা. পবিত্র কুরআনের এই আয়াত তেলায়াত করলেন-  এ দু’ জান্নাতের  ومن دونهما جنتان তলদেশে রয়েছে আরো দু’টি জান্নাত। আর এই জান্নাতদ্বয়ের
ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- ‘কেউ জানেনা তার জন্য কি কি নয়নপ্রীতিকর প্রতিদান লাকিয়ত আছে।’ [সূরা সেজদা : ১৭] ইহা সে জান্নাত যার ব্যাপারে সৃষ্টি জগত অবগত নয় যে, তাতে কি রয়েছে। এ সমস্ত জান্নাতীদের নিকট দৈনিক সালাম প্রদান করা হয়।
দশ লাখ খাদেমের সাথে ভ্রমণ
হযরত হাসান বসরী রহ. থেকে বর্ণিত নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, জান্নাতি লোকদের মধ্যে নিম্নমানের জান্নাতি এমন হবে যে, তিনি লাল ইয়াকুতের ঘোড়ায় আরোহণ করবেন। এ ঘোড়ার ডানা হবে স্বর্ণের এবং তার সঙ্গে দশ লক্ষ খাদেম থাকবে। ফেরেশতাদেরও তার কাছে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। আল্লাহর বাণী, ‘আপনি যখন সেখানে দেখবেন, তখন নেয়মতরাজি ও বিশাল রাজ্য দেখতে পাবেন।’ [দাহর-২০]। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবু সুলায়মান দারাঈ রহ. বলেন, বিশাল রাজ্যে জান্নাতি লোকের কাছে আল্লাহর দূতেরা হাদিয়া তুহফা নিয়ে আগমন করবেন। কিন্তু ফেরেস্তারা তার নিকট পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। তিনি পাহারাদারকে বলবেন তুমি আল্লাহ পাকের বন্ধুর কাছ থেকে অনুমতি  এনে দাও। কেননা অনুমতি ব্যতিরেকে আমি তার কাছে পৌঁছতে পারবনা। তখন সে পাহারাদার দ্বিতীয় পাহারাদারকে বলবে। তারপর তাকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। সে জান্নাতিলোকদের মহল থেকে দারুচ্ছালাম পর্যন্ত এমন একটি দারজা হবে যা দিয়ে সে তার পরওয়ারদিগারের নিকট যখন চাইবে অনুমতি ব্যতীতই যেতে পারবে। সুতরাং ইহাই বিশাল রাজ্য যে, আল্লাহ পাকের দূতও সে জান্নাতির অনুমতি ব্যতীত যেতে পারবেনা। অথচ জান্নাতিলোক যখন তখন রবের কাছে উপস্থিত হতে পারবে।
সৌন্দর্য ও পবিত্রতার কোন গুণ বর্ণনা করা সম্ভব নয়
আল্লাহরবাণী- رأيت نعيما وملكا كبيرا  এর ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কোন মানুষই এর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারবেনা।
বাদশাহদের স্থান: হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, নবী কারীম সা. ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ তাআলা জান্নাতের একটি ইট স্বর্ণের একটি ইট রৌপ্য দিয়ে গেথেছেন। তারপর এর মধ্যে ঝর্ণা প্রবাহিত করেছেন ও বৃক্ষ রোপণ করেছেন। সুতরাং ফেরেশতারা যখন জান্নাতের সৌন্দর্য দেখল, তখন বলল, ওহে জান্নাত তোমাদের মধ্যে বাদশাহদের অবতরণ স্থল সুখের হোক।
জান্নাত হলো শ্রেষ্ট প্রতিদান ও উত্তম পুরুষ্কার
আল্লাহ ইরশাদ ফরামন- নিশ্চয় মুসলামান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালানকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, লাজ্জাস্থান হেফাজতকারী পুরুষ, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ, অধিক যিকিরকারী নারী, তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরুষ্কার। [আহযাব-৩৫]
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তানাদি তোমাদের পরিক্ষার বস্তু। আর নিশ্চই আল্লাহ তাআলার নিকট রয়েছে মহা পুরুষ্কার [মায়িদা-১৮, আনফাল-২৮, তাগাবুন-১৫]
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য স্থানে নেক আমলের বিনিময়ে মহা পুরুষ্কারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর মধ্য থেকে পাঠকের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি স্থান উল্লেখ করা হল মাত্র-
এক. যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে এবং শহীদ হয় অথবা নামাযী হয় তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরুষ্কার।
দুই. ঈমান গ্রহণের পর যারা আল্লাহভীতি অর্জন করে তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরুষ্কার।
তিন. যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও প্রতিদান।
চার. যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বর নিচু করে আল্লাহ তাদের অন্তুরকে শিষ্টাচারের জন্য শোধিত করেছেন তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও পুরুষ্কার। [হুজরাত-৩]
পাঁচ. অবশ্য যারা তওবা করেছে, নিজেদের অবস্থার সংশোধন করেছে, এবং আল্লাহর পথকে সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে আল্লাহ পাকের অনুগত হয়েছে। তারা থাকবে মুসলমানদেরই সাথে। বস্তুত আল্লাহ শীঘ্রই ঈমানদারগণকে মহাপূণ্য দান করবেন [নিসা-১৮৬]।
ছয়. তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানপক্ক ও ঈমানদার তারা তাও মান্য করে যা আপনার উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনার পূর্বে। যারা নামাযে অনুবর্তিতা পালনকারী, যারা যাকাত দানকারী এবং যারা আল্লাহ ও কিয়ামতে আস্থাশীল। বস্তুত এমন লোকদের আমি দান করব মহাপূণ্য [ নিসা-১৬২]।
সাত. মোহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখম-লে সেজদার চিহ্ন। তাওরাতে তাদের অবস্থা এরুপ এবং ইঞ্জিলেও যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়। তারপর তা শক্ত মজবুত হয় এবং কা-ের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে। চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে, যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তুর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরুষ্কারের ওয়াদা দিয়েছেন। [ফাত্হ- ২৯]
আট. আপনি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহ কে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরুষ্কারের সুসংবাদ দিয়ে দিন। [ইয়াসীন-১১]
নয়. কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ধার দিবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরুষ্কার। [হাদীদ-১১]
দশ. তবে যারা ধৈর্যধারণ করেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান রয়েছে। [হুদ-১১]
জান্নাতের যমীন, কাদা, কংকর ও ইমারত
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবী কারীম সা. ইরশাদ ফরমান- জান্নাতের একটি ইট স্বর্ণের অপরটি রৌপ্য নির্মিত। এর মাটি জাফরানের এবং মশলা কস্তরীর।
মেরাজের দীর্ঘ হাদীসে আল্লাহর নবী ইরশাদ ফরমান- আমি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখলাম। এতে চমকদার মোতি গ্রথিত। এর যমীন ছিল কস্তুরীর। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, হযরত ইবনে সায়্যাদ জান্নাতের মাটি সম্পর্কে নবী কারীম সা. কে জিজ্ঞেস করলে হুজুর সা. বলেন, তার মাটি নরম মোলায়েম উজ্জল শুভ্র, নিরেট কস্তুরীর মাটি।
জান্নাতের যমীন সমতল মসৃণ
হযরত উবাইদ উমাইয়া বলেন, জান্নাতের যমীন সমতল ও মসৃণ। এর ঝর্ণাসমূহ যমীন কে বিদীর্ণ করে প্রবাহিত হচ্ছে।
জান্নাতের যমীনে রহমতের হাওয়া বইতে থাকায় জান্নাতিদের সৌন্দর্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সা. ইরশাদ ফরমান, জান্নাতের যমীন শুভ্র। এর মাঠ হবে কাফুরের প্রান্তর। এই মাঠের বালুরাশি টিলার ন্যায় কস্তুরী দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। এতে আবার নহর প্রবাহিত। এই ঝর্ণাতে সব ধরনের জান্নাতিরা একত্রিত হবে। তারা এখানে পরস্পর পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং একে অপরের সাথে পরিচিত হবে। তাদের উপর আল্লাহ পাকের রহমতের বাতাস বইতে থাকবে। এই রহমত জান্নাতিদেরকে আরো সুবাষিত করে তুলবে। তারপর জান্নাতি পুরুষরা যখন নিজ নিজ স্ত্রীদের কাছে ফিরে যাবেন এবং তারা তাদের সৌন্দর্য ও পবিত্রতায় আরো বৃদ্ধি পেয়ে রইবে তখন স্ত্রীরা বলবে, আপনি যখন আমার কাছ থেকে গিয়েছিলেন তখনই আমি আপনার প্রেমে পাগল ছিলাম এখন তো সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেল। হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, হুজুর সা. কে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ  জান্নাত কি দিয়ে তৈরি? উত্তরে তিনি বলেন, জান্নাতের একটি ইট রৌপ্যের আরেকটি ইট স্বর্ণের এবং মসলা সুগন্ধিময় কস্তুরীর, এর কংকর চমকদার মোতি এবং ইয়াকুতের, আর মাটি হলো জাফরানের।

Post a Comment

Previous Post Next Post